War Of Superiority Series

War Of Superiority Series


শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই পর্ব ১:- হিন্দুত্ববাদ ও পশ্চিমা ‘অল্টার-রাইট’র উত্থান!


হিন্দুত্ববাদী এবং পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ! এ তথ্যই জানিয়েছে আল-জাজিরা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট! ট্রাম্প বা শ্বেতাঙ্গরা যেরূপ সারাবিশ্বে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করতে চায়, ঠিক সেভাবেই হিন্দুত্ববাদীরাও উপমহাদেশে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়! ভারতকে প্রতিষ্ঠা করতে চায় একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে, যেখানে থাকবে না কোন মুসলিমের নাম-গন্ধ!

বিগত কিছু বছর ধরে পশ্চিমে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের আধিপত্যের বিস্তার ঘটেছে, আর শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদকে যেন স্বাভাবিকই মনে করা হয়, এরূপ একটি চেতনা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। ২০১৬ সালে ট্রাম্পের বিজয় অর্জনের পর এর মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে!

ট্রাম্পের এসকল উগ্র নীতি যখন সকলের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, তখন এই নীতিগুলোই সাদরে গ্রহণ করেছে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা!

শ্বেতাঙ্গবাদী, নব্য নাৎসি এবং হিন্দুত্ববাদীরা মিলে একটি মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে, তা হলো- বর্ণবাদ, বিদেশী বিদ্বেষ, বিভেদসৃষ্টিকরণ! তাদের সকলের মনোযোগ এখন ভারতের উপর!

নতুন এই জোড়াতালি দেওয়া দলটিকে সাধারণত “অল্টারনেটিভ-রাইট বা অল্টার-রাইট” বলে সম্বোধন করা হয়। এই দলটি তাদের মতবাদকে ভারতের সমাজব্যবস্থায় বাস্তবায়নের আশা ব্যক্ত করেছে। এরই লক্ষ্যে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ভারতে কাজ করে যাচ্ছে!

উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সাথে পশ্চিমা ‘অল্টার-রাইট’ দলগুলোর মিত্রতা নতুন মনে হলেও এর এক বিস্তর ইতিহাস রয়েছে। তাদের মিত্রতার মূলে রয়েছে আর্য জাতীয়তাবাদ! আর এ আর্য জাতির মতবাদই ছিল হিটলারের নাৎসি মতবাদের মূল উৎসের একটি!

 

উনিশ শতকে জার্মান জাতীয়তাবাদীরা এই মতবাদের জন্ম দেয় যে, ইউরোপীয় ও ভারতের সংস্কৃত ভাষাভাষী লোকেরা ইন্দো-ইউরোপীয় বা আর্যদের থেকে এসেছে! অর্থাৎ, জার্মানীর ইউরোপীয় এবং ভারতের সংস্কৃত ভাষাভাষী লোকদের পূর্বপুরুষ একই দলভুক্ত! এখান থেকেই তাদের ভয়ংকর বর্ণবাদের উৎপত্তি ঘটে, যা পর পর দুটি বিশ্বযুদ্ধেও ভয়াবহ ভূমিকা রাখে!  

 

 

 

 

শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই পর্ব ২: নাৎসি এবং হিন্দুত্ববাদে সাবিত্রি দেবীর ভূমিকা!


১৯৩০ সালের দিকে আর্য সভ্যতার উৎসের সন্ধানে ভারতে আসে সাবিত্রি দেবী! সে একজন ফরাসি-গ্রিক চিন্তাবিদ ও বহুইশ্বরবাদী ছিল । পরবর্তীতে সে নাৎসিদের আধ্যাত্মিক আইকনে পরিণত হয়। সকল সভ্যতার মূলে হলো আর্যজাতি এই মতবাদকে সে পরিচিত করার প্রচেষ্টা চালায়। ভারতে এসে সে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে। সাবিত্রী দেবী হিটলারকে নিজের নেতা মনে করতো এবং হিন্দুদের ভগবান বিষ্ণুর অবতার মনে করতো!

ভারতে এসে দ্রুতই সে ভারতের চলমান হিন্দুত্ববাদ ইস্যুতে জড়িয়ে পড়ে এবং উঁচু বর্ণের হিন্দুরা মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং নিচু বর্ণের হিন্দুদের থেকে শ্রেষ্ঠ, এই মতবাদ প্রচার করতে থাকে! ১৯৪০ সালে সে অশিত কৃষ্ণ মূখার্জীকে বিয়ে করে। অশিত ছিল একজন হিন্দুত্ববাদী ও নাৎসি সমর্থক। সে ভারতের বর্তমান উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংঘ আরএসএস ও হিটলারের নাৎসি মতবাদের মিল দেখে নাৎসিদের ব্যাপক প্রশংসা করে।

সাবিত্রি দেবি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের হয়ে ভারতে গুপ্তচরের ভূমিকা পালন করে এবং জার্মানির পরাজয়ের পর দেশ ত্যাগ করে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নব্য নাৎসি এবং সমমতাদর্শীদের নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক নাৎসি ইউনিয়নের গুরুত্বপুর্ণ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন ছিল সে।

সাবিত্রি দেবির প্রভাব এখনও ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের উপর লক্ষ্যণীয়। ১৯৩৯ সালে তার লেখা “এ ওয়ার্নিং টু দ্যা হিন্দুস” নামক বই এখনও সবচেয়ে পঠিত বই গুলোর মধ্যে একটা। এই বইয়ে সে হিন্দুদের সতর্ক করেছে যেন তারা তাদের হিন্দু পরিচয় বহাল রাখে এবং তাদের দেশকে ইসলাম, খ্রিষ্টানদের মত অনার্য সকল জাতি থেকে বিশুদ্ধ রাখে। সম্প্রতি, পশ্চিমা দেশগুলোতে ডানপন্থী মতাদর্শীরা সাবিত্রি দেবীর মতবাদের পুনরুত্থান ঘটিয়েছে এবং তাকে অল্টার-রাইট গ্রুপের একজন আইকন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কিন্তু বর্তমানে, উগ্র ডানপন্থী ও হিন্দুদের মধ্যে যেই বন্ধুভাব তা দেবির চিন্তা ও পৌরানিক আর্য নিয়মে আবদ্ধ নেই। বর্তমানে উভয়ের একই লক্ষ্য, তা হলো- নিজ নিজ দেশে তাদের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করা এবং তা মানতে সবাইকে বাধ্য করা। আর দুটি দলেরই শত্রু মুসলিমরা! এই জন্যই তারা একসাথে কাজ করে এবং একজন অপরজনকে সরাসরি সমর্থন করে।

 

 

 

 

 

 

শ্রেষ্ঠত্যের লড়াই পর্ব ৩: বহির্বিশ্বের সাথে হিন্দুত্ববাদীদের আঁতাত! আধিপত্য বিস্তারের মতবাদ!


ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক হিন্দু জোটের খুবই শক্তিশালী সম্পর্ক আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিমদের উপর নিষেধাজ্ঞার বিতর্কিত আইনটির ক্ষেত্রে হিন্দু সংগঠনগুলোর পূর্ণ সমর্থন ছিল। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার পরিকল্পনাকারী ও একজন অল্ট-রাইট ব্যক্তিত্ব স্টিভ ব্যানন একবার উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ভারতের রেগান বলে সম্বোধন করেছিল। রেগান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ৪০তম প্রেসিডেন্ট।

ইতোমধ্যে, ভারতে হিন্দুত্ববাদী দল “হিন্দু সেনা” ট্রাম্পের জন্মদিন উপলক্ষ্যে উৎসব করে বেড়াচ্ছে। এই দলগুলো ভারতের বড় বড় ধর্মকেন্দ্রিক দাঙ্গার সাথে জড়িত। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা এমনও দাবি করেছে যে, ট্রাম্পই একমাত্র ব্যক্তি যে মানবজাতিকে বাঁচাতে পারে।

কানাডাতে “রাইজ কানাডা’’র মত ইসলাম বিরোধী দলগুলো হিন্দুদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এ দলটি কানাডার মূল্যবোধ রক্ষা ও ইসলামের সাথে যুদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই সংস্থা ও হিন্দু দলগুলোর মধ্যে মিত্রতা এত বেশি যে দলটির লোগোর মধ্যে দেখা যায়, একটা ম্যাপল পাতা পদ্ম ফুল থেকে বের হচ্ছে। ম্যাপল পাতাকে কানাডার প্রতিক ও পদ্মফুলকে হিন্দুদের প্রতিক হিসেবে হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যুক্তরাজ্যের সংসদে সম্প্রতি এক উগ্র হিন্দু তপন ঘোষকে বক্তব্য রাখার জন্য ডাকা হয়। এই আমন্ত্রণ খুব বিতর্কের বিষয় ছিল। তপন আগে এমন বক্তব্য দিয়েছে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে মুসলিমদের জন্মহার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। তপন যুক্তরাজ্যে থাকাকালীন সময়ে দিপাবলির অনুষ্ঠান উৎযাপন করে ও সংসদ সদস্য এম্বার রুট ও প্রিতি পাটেলের সাথে দেখা করে। সে সাবেক নতুন নাৎসি নেতা টমি রবিনসনের সাথেও দেখা করে।

হিন্দুত্ববাদী এবং পশ্চিমা চরম ডানপন্থীদের মাঝে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ছাড়াও সামরিক আগ্রাসনের মধ্যেও মিল পাওয়া যায়।

২০১৮ সালের নভেম্বরে ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের অয্যোধ্যাতে ৭০০ ফুটেরও উঁচু এক রাম মূর্তি বানানোর আবেদন করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। এর আগে এই স্থানটিতে থাকা মুসলিমদের ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ১৯৯২সালের ডিসেম্বরে ধ্বংস করে ফেলে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা, সে ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি! এই একই ভূমিতে এই বছর দিপাবলিতে বিজেপি সরকার এক বিশাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে, যেখানে রাম-সীতার সাঁজে হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসে হিন্দুত্ববাদীরা।

এই ধরনের মুসলিমবিরোধী কাজগুলো অনেকটাই পশ্চিমের চরম-ডানপন্থিদের সাথে মিলে যায়। চরম-ডানপন্থিরাও মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই ধরনের কাজ করে থাকে এবং চিন্তাধারা রাখে। ২০১৭ সালে শ্বেতাঙ্গদের চারলটসভিলের ঘটনার সাথে ভারতের বাবরি মসজিদের ঘটনার অনেক মিল পাওয়া যায়। নতুন নাৎসিরা চারলটসভিলের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে স্লোগান দিচ্ছিল, “তুমি আমাদের পরিবর্তন করতে পারবে না”।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা যেভাবে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, হিন্দুত্ববাদীরাও তাদের মত আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখে। ২০১৪ সালে বিজেপির বিজয় লাভের পর হিন্দুত্ববাদীরা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে উঠে পড়ে লাগে!  মুসলিমবিহীন হিন্দুত্বরাষ্ট্র ভারতের স্বপ্ন দেখতে থাকে!

যখন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের শাসনব্যবস্থা হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের হয়ে যায়, তখন পশ্চিমা দেশগুলোর মত ভারতেও মুসলিমদের উপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন! গত কিছু বছর ধরে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী গো-রক্ষকদের হাতেই অনেক মুসলিম হতাহত হয়েছেন। শাসকগোষ্ঠীর প্রকাশ্য মদদে এসকল হত্যাকাণ্ড চালানো হয় মুসলিমদের উপর। হিন্দুদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৮ বছরের শিশু থেকে শুরু করে প্রবীণ মুসলিমরাও! হত্যা করার পাশাপাশি মুসলিম মহিলাদেরকে ধর্ষণও করেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। মন্দিরে আটকে রেখে মুসলিম শিশুকে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটিয়েছে এই হিন্দুরা।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- পশ্চিমা উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে কেউ কেউ প্রতিবাদ জানালেও, উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে এখনও নিরব বিশ্ববাসী। বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে সকল চক্রান্ত সেই মুসলিমরাই কেমন জানি হিন্দুত্ববাদীদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অজ্ঞ! ভারতে চলমান মুসলিমবিরোধী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কারো মুখে আওয়াজ উঠে না!

আজ সেক্যুলারিজমের দাবিদাররাও হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের চক্রান্ত নিয়ে কথা বলে না! বরং, ভারতের বামপন্থী অর্থাৎ কথিত উদারপন্থীরাও হিন্দুরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে অনেকটা গ্রহণ করে নিয়েছে! আর পশ্চিমা তৃণভোজীরা কথিত গো-রক্ষকদের হাতে মুসলিমদের নিহত হওয়ার খবরে উচ্ছাসিত হচ্ছে।

 

Report Page